জীবনের সেরা সময় কাটিয়েছেন শিক্ষার্থীদের সঙ্গে। টানা ৩৫ বছরের শিক্ষকতা শেষে ২০২৩ সালের ৩১ ডিসেম্বর অবসরে যান। অথচ এখনও পাননি কল্যাণ ও অবসর ভাতার প্রাপ্য অর্থ। ফলে বয়সের ভারে নানা জটিল রোগে ভুগলেও ঠিকমতো চিকিৎসা নিতে পারছেন না মাদরাসা শিক্ষক মৌলভী মো. নাদের হোসেন (৬১)।
১৯৬৪ সালের ১ জানুয়ারি শেরপুরের শ্রীবরদী উপজেলার গারো পাহাড়-সংলগ্ন রাণীশিমূল পাইলট ইউনিয়নের বিলভরট (পূর্ব) গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক নাদের হোসেন। তার বাবা শামছুল হক আকন্দ। পাঁচ ভাই ও চার বোনের মধ্যে তিনি সপ্তম। ছোটবেলা থেকেই তিনি ধর্মীয় শিক্ষায় মনোযোগী ছিলেন। ১৯৭৪ সালে ভায়াডাঙ্গা এ. এম. সিনিয়র মাদ্রাসা থেকে দাখিল, ১৯৭৭ সালে আলিম এবং ১৯৭৯ সালে ফাজিল (বি.এ) পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন।
ছাত্রজীবন থেকেই মক্তবে কোরআন শরিফ পাঠদান শুরু করেন তিনি। ১৯৮১ সালের ১ সেপ্টেম্বর বকচর কন্টিপাড়া দারুস সালাম দাখিল মাদরাসায় সহকারী মৌলভী হিসেবে যোগ দেন। দক্ষতা ও নিষ্ঠার কারণে ১৯৮৭ সালের ১ আগস্ট তিনি এমপিওভুক্ত হন।
শিক্ষকতার পাশাপাশি দীর্ঘদিন স্থানীয় মসজিদে খতিব ও ইমাম হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন তিনি। ১৯৯৭ সালে ভায়াডাঙ্গা পুরাতন ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) পাশে প্রতিষ্ঠা করেন ভায়াডাঙ্গা টি.আর.ডিসি কিন্ডারগার্টেন, যেখানে তিনি ছিলেন প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি।
শিক্ষার্থীদের সাফল্য ও শিক্ষার প্রসারে শিক্ষক মো. নাদের হোসেনের অবদান এলাকায় বিশেষভাবে সমাদৃত। অবসরের পর থেকে নাদের হোসেন ভুগছেন শ্বাসকষ্ট (অ্যাজমা), হৃদরোগসহ নানা বার্ধক্যজনিত জটিলতায়। প্রতিদিন প্রায় ২০০ টাকা ব্যয়ে ওষুধ সেবন করতে হয় তাকে। কিন্তু কল্যাণ ও অবসর ভাতার টাকা আটকে থাকায় চিকিৎসা খরচ চালাতে হিমশিম খাচ্ছেন। তার বড় ছেলে মাওলানা রাশেদ মাহমুদ বাবার চিকিৎসা ও সংসারের খরচ বহন করছেন।
নাদের হোসেন বলেন, আমরা জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময়টা ছাত্রদের সঙ্গে কাটিয়েছি। শিক্ষকতা পেশাটাকে আমি খুব ভালোভাবে উপভোগ করেছি। আমি সবসময় চেষ্টা করেছি সবার সঙ্গে মিলেমিশে থাকতে। কিন্তু এখন আমার শেষ জীবনে চিকিৎসার জন্য টাকার প্রয়োজন। কল্যাণ ও অবসর ভাতা না পাওয়ায় চিকিৎসা করতে পারছি না। আমি কারও কাছ থেকে সহযোগিতা চাই না, আমি শুধু আমার প্রাপ্য টাকা চাই। এটা পেলে অন্তত আমার ছেলের ওপর চাপটা কিছুটা কমে যেত।
বড় ছেলে মাওলানা রাশেদ মাহমুদ বলেন, আমাদের বাবা আমাদের জন্য কষ্ট করেছেন, আমাদের পড়াশোনা করিয়েছেন। বাবা হিসেবে তিনি তার দায়িত্ব পালন করেছেন আন্তরিকতার সঙ্গে। আমরা চেষ্টা করছি বাবার পাশে থাকার। কিন্তু অবসর ভাতা পেলে বাবার চিকিৎসা আরও ভালোভাবে করা যেত। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নিয়ম অনুযায়ী চাকরি শেষ হওয়ার ছয় মাসের মধ্যে ভাতা দেওয়ার কথা, অথচ প্রায় দুই বছর পার হয়ে গেলেও এখনো দেওয়া হয়নি। অবসরে যাওয়া প্রায় ৮০ হাজার শিক্ষকের ভাতার ফাইল এখনো পেন্ডিং। এটি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বহীনতার পরিচয়। আমরা চাই দ্রুত বাবার ভাতা দেওয়া হোক, যেন তার শেষ বয়সটা ভালোভাবে কাটে।
বকচর কন্টিপাড়া দারুস সালাম দাখিল মাদরাসার সহকারী মৌলভি রশীদ আহমাদ বলেন, নাদের স্যার ছিলেন খুব ভালো মানুষ। তিনি কখনো কোনো গাফিলতি করেননি। সবসময় শিক্ষার্থীদের কল্যাণে কাজ করেছেন।
একই মাদ্রাসার সুপার আ.ব.ম ইদ্রিছ আলী ফারুকী বলেন, নাদের সাহেব খুব আন্তরিক শিক্ষক ছিলেন। তার পড়ানোর মান খুব ভালো ছিল। প্রতিষ্ঠানের উন্নতিতে তার অবদান অনেক। কিন্তু অবসরে যাওয়ার দুই বছর পরও তিনি প্রাপ্য ভাতা পাননি। এতে তিনি চিকিৎসা করতে পারছেন না—এটি অত্যন্ত কষ্টের বিষয়। শুধু তিনি নন, অবসরে যাওয়া অনেক শিক্ষকই এই সমস্যায় ভুগছেন। আমরা চাই, অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষকরা দ্রুত তাদের প্রাপ্য টাকা পান।
শেরপুর জেলা শিক্ষা অফিসার মো. রেজুয়ান বলেন, কল্যাণ ও অবসর ভাতার আবেদন অনলাইনে ঢাকায় জমা দিতে হয়। জেলা পর্যায়ে সরাসরি কিছু করার সুযোগ নেই। তবে শিক্ষকরা অবসরে গিয়ে প্রাপ্য টাকা পেতে দেরি হওয়ায় ভোগান্তিতে পড়েন। এটি আমাদেরও খারাপ লাগে। বিষয়টি কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে। আগামী বৈঠকে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হবে।
অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক নাদের হোসেনের গল্প হাজারো শিক্ষকের দুঃখ-দুর্দশার প্রতিচ্ছবি। জীবনের সেরা সময়টি শিক্ষার্থীদের জন্য ব্যয় করার পরও শেষ বয়সে তারা যখন প্রাপ্য ভাতার জন্য অপেক্ষা করতে বাধ্য হন, তখন তা কেবল তাদের নয়, গোটা সমাজের জন্যই বেদনাদায়ক বাস্তবতা।